Saturday, January 30, 2016

পৃথিবীর ৪০ দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমার ব্যবসা : মুসা

‘সুইস ব্যাংকে মুসা বিন শমসেরের ১২ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯৩ হাজার ছয় শ কোটি টাকা), ‘ফ্রিজ’ অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়াও সুইস ব্যাংকের ভল্টে ৯০ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি প্রায় সাত শ কোটি টাকা) দামের অলংকার জমা রয়েছে। এমনকি গাজীপুর ও সাভারে তাঁর নামে প্রায় এক হাজার দুই শ বিঘা সম্পত্তিও রয়েছে।’
দুদকে দেওয়া সম্পদ বিবরণী অনুযায়ী এসব তথ্য জানা গেছে। ২০১৪ সালের জুন মাসে বিজনেস এশিয়া নামে একটি সাময়িকীতে মুসাকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ওই বছরের ৩ নভেম্বর তাঁর সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। সবশেষে দুদক গতকাল তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জিজ্ঞাসাবাদ শেষে নিজের সম্পদ সম্পর্কে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি আজ বলেছেন, ‘‘আমি ধোলাইখাল থেকে পানি নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগর গড়িনি। আর বাংলাদেশ থেকে হুন্ডি করে বিদেশে এত টাকা জমানো সম্ভব নয়। পৃথিবীর ৪০টি দেশের সঙ্গে আমার ব্যবসা, ৪০ দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমার ব্যবসা। সেই সব দেশের সঙ্গে যত বিল সেটেল হয়েছে তা সুইস ব্যাংকে ট্রান্সফার হয়েছে। বরং আমার কোম্পানির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা দেশে এনেছি।’’
দুদকে দেওয়া সম্পদ বিবরণী অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ৭ জুন সুইস ব্যাংকে মুসা বিন শমসেরের ১২ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯৩ হাজার ছয় শ কোটি টাকা), ‘ফ্রিজ’ অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়াও সুইস ব্যাংকের ভল্টে ৯০ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি প্রায় সাত শ কোটি টাকা) দামের অলংকার জমা রয়েছে।
গাজীপুর ও সাভারে তাঁর নামে প্রায় এক হাজার দুই শ বিঘা সম্পত্তি রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন মুসা। বর্তমান বাজার দরে এসব জমির মূল্য এক হাজার দুই শ কোটি টাকারও বেশি। অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে থাকায় এসব সম্পত্তির খাজনা পরিশোধ করে নামজারি করা সম্ভব হয়নি বলে জানান মুসা।
সুইস ব্যাংকে ১২ বিলিয়ন ডলার কেন জব্দ অবস্থায় রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইরেগুলার ট্রানজেকশনের কারণে করেছে।’ এ টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে প্রশ্ন করলে মুসা বলেন, ‘এটা একটা বিচারাধীন বিষয়। আমি বাদী হয়ে মামলা করেছি। বিচারাধীন যে কোনো বিষয়ে কথা বলা অবৈধ। আমি মামলায় জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। এ বিষয়ে দুদককে আমি সব তথ্য দিয়েছি।’
বিতর্কিত এ ব্যবসায়ীর কথিত বিপুল পরিমাণ সম্পদের রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে চলতি মাসের ৪ তারিখে তৃতীয়বারের মতো তাঁকে তলব করে নোটিশ দেয় দুদক। পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী স্বাক্ষরিত ওই তলবি নোটিশে তাঁকে ১৩ জানুয়ারি বেলা ১১টায় সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছিল। কিন্তু অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে গত ১২ জানুয়ারি দুদকের তলবে হাজির হতে পারছেন না বলে মুসা বিন শমসের যে চিঠি পাঠিয়েছেন, তাতে বলা হয়, তিনি মৃত্যু আতঙ্কে (ডেথ ফোবিয়া) ভুগছেন। সেই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসও তাঁকে ভোগাচ্ছে। চিকিৎসকের সনদ যুক্ত করে দুদককে দেওয়া চিঠিতে তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় দুই থেকে তিন মাস পেছানোর আবেদন করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক ২৮ জানুয়ারি নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্ধারণ করে মুসাকে চিঠি পাঠায়।
অসুস্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ডেথ ফোবিয়া হচ্ছে ভয়ংকর মানসিক রোগ। যখন ওই দুর্ঘটনা (সুইস ব্যাংকের টাকা ফ্রিজ করা) হলো তখন থেকে আমি এই রোগে ভুগছি। মাঝখানে শরীরের অবস্থা আরও খারাপ ছিল, এখন একটু ভালো।’’
‘‘আমাদের দেশের কোনো মানুষ কি এই পরিমাণ টাকা অর্জনের কল্পনা করতে পারবে! আমি এর আগেও বলেছিলাম আগামী ৫০ বছরেও এই টাকা কেউ অর্জন করতে পারবে না। আর এ কারণে আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি।’’
এদিকে দুদক মনে করছে, মুসা বিন শমসেরের দেওয়া সম্পদ বিবরণীর তথ্যে গরমিল আছে। মুসার অসহযোগিতার কারণে এ বিষয়ে অনুসন্ধান শেষ করতে দেরি হচ্ছে। দুদক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন এসব কথা বলেন।
মুসার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদকের এই শীর্ষ নির্বাহী বলেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা মুসার সুইস ব্যাংকের ওই অ্যাকাউন্টের তথ্য পাবো।’ তবে অনুসন্ধানে বেশ অগ্রগতি হয়েছে জানিয়ে দুদক কমিশনার বলেন, এখন আর তেমন সময় লাগবে না। মুসার বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনুসন্ধান শেষে বলা যাবে।
এদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর বিতর্কিত ভূমিকা সম্পর্কে নানা আলোচনা প্রসঙ্গে মুসা নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত আমি বঙ্গবন্ধুর বাসায় ছিলাম। তারপর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নিজ জেলা ফরিদপুরে চলে যাই। ২১ এপ্রিল আমার জেলা ফরিদপুরে পাকিস্তানি আর্মি ঢুকল। ২২ এপ্রিল আমি তাদের হাতে ধরা পড়লাম। আর মুক্তি পেলাম ৯ ডিসেম্বর অর্ধমৃত অবস্থায়। তাহলে আর কি ভূমিকা থাকবে আমার। আমাকে নিয়ে যে অভিযোগ তা ভিত্তিহীন।’
এর আগে বিশাল গাড়ির বহর আর সুসজ্জিত ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর অর্ধশত সদস্য নিয়ে দুদকে আসেন মুসা। কিন্তু নিরাপত্তারক্ষীদের বাইরে রেখেই তাঁকে ভেতরে ঢুকতে হয়। দুদকের প্রধান ফটক কার্যদিবসে খোলা থাকলেও এদিন বন্ধ রাখা হয়। দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং গণমাধ্যমকর্মী ছাড়া কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। দুদকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা জানান, বিনা প্রয়োজনে যাতে কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারে সে জন্য ফটক বন্ধ রাখার নির্দেশনা রয়েছে।
বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে অনুসন্ধান দলের সদস্যরা।
এর আগে ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রথম জিজ্ঞাসাবাদে বিশাল বাহিনী নিয়ে দুদকে প্রবেশ করেছিলেন মুসা। এক বছর এক মাস পর একই কায়দায় এলেও তার সঙ্গে আসা কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি।
২০১৪ সালের জুন মাসে বিজনেস এশিয়া নামে একটি সাময়িকীতে মুসাকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ওই বছরের ৩ নভেম্বর তাঁর সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। ১৮ ডিসেম্বর প্রায় ৪০ জন ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর বহর নিয়ে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হন তিনি। পরে দুদকের অনুসন্ধান দলটি মুসার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ড্যাটকোতে গিয়ে তাঁকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
ওই জিজ্ঞাসাবাদে মুসা দাবি করেন, দীর্ঘদিন বিদেশে বৈধভাবে ব্যবসার মাধ্যমেই তিনি ১২ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছেন। সৌদি আরব, কুয়েত, ইরাক, মিসর, সিরিয়া ও পাকিস্তানসহ অনেক দেশের সরকারি প্রতিরক্ষা ক্রয় সংক্রান্ত পাওনা পরিশোধের অর্থ ওই সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সুইস ব্যাংকে তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে।

No comments:

Post a Comment